Monday, May 15, 2017

সোনার তরী-Sonar tori

সোনার তরীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
     কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
            রাশি রাশি ভারা ভারা
            ধান কাটা হল সারা,
            ভরা নদী ক্ষুরধারা
                    খরপরশা।
     কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
     একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
     চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
            পরপারে দেখি আঁকা
            তরুছায়ামসীমাখা
            গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
                    প্রভাতবেলা--
     এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
     গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
            ভরা-পালে চলে যায়,
            কোনো দিকে নাহি চায়,
            ঢেউগুলি নিরুপায়
                    ভাঙে দু-ধারে--
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
     বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
            যেয়ো যেথা যেতে চাও,
            যারে খুশি তারে দাও,
            শুধু তুমি নিয়ে যাও
                    ক্ষণিক হেসে
     আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
     যত চাও তত লও তরণী-'পরে।
     আর আছে?-- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
            এতকাল নদীকূলে
            যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
            সকলি দিলাম তুলে
                    থরে বিথরে--
     এখন আমারে লহ করুণা করে।
     ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
     আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
            শ্রাবণগগন ঘিরে
            ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
            শূন্য নদীর তীরে
                    রহিনু পড়ি--
     যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।


সংকল্প-কাজী নজরুল ইসলাম

   সংকল্প                 কাজী নজরুল ইসলাম



         থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
              দেখব এবার জগৎটাকে
                 কেমন করে ঘুরছে মানুষ
             যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
                দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
                ছুটছে তারা কেমন করে,
                   কিসের নেশায় কেমন করে
             মরছে যে বীর লাখে লাখে।
                 কিসের আশায় করছে তারা
     বরণ মরণ যন্ত্রণাকে
           কেমন করে বীর ডুবুরি
              সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
         কেমন করে দুঃসাহসী
          চলছে উড়ে স্বর্গপানে।
               হাউই চড়ে চায় যেতে কে
              চন্দ্রলোকের অচিনপুরে,
                     শুনব আমি, ইঙ্গিতে কোন
                  মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।
                  পাতাল ফেড়ে নামব আমি
                  উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
             বিশ্বজগৎ দেখব আমি
                    আপন হাতের মুঠোয় পুরে।


আনন্দময়ীর আগমনে-Anondomoyeeragomone by kazi nazrul islam

আনন্দময়ীর আগমনে কাজী নজরুল ইসলাম


আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? 
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। 
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, 
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? 

মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি 
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। 
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, 
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা। 

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে 
রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- 
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, 
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। 
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা 
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।.. 

'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী 
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!




রক্তাপ্লুত শার্ট-শামসুর রাহমান

রক্তাপ্লুত শার্ট
শামসুর রাহমান



বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।


‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ’রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।


বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
উনিশ শো উনসত্তরের
তরুণ চীৎকৃত রৌদ্রে যে-ছেলেটা খেলতো রাস্তায়,
বানাতো ধুলোর দুর্গ, খেতো লুটোপুটি নর্দমার ধারে
বিস্ময়ে দেখতো চেয়ে ট্রাক, জীপ,
রাইফেল, টিউনিক, বেয়োনেট, বুট, হেলমেট,
এখন সে টলমল পদভরে শরীক মিছিলে।
লাজনম্র যে মেয়েটি থাকতো আড়ালে সর্বক্ষণ,
যে ছিল অসূর্যস্পশ্যা, এখন সে ঝলসায় মিছিলে মিছিলে।
তাদের পায়ের নিচে করে জ্বলজ্বল নীল নকশা নব্য সভ্যতার।


বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হতাশাকে লাথি মেরে, ভয়কে বেদম লাঠি পেটা ক’রে
সবখানের শ্লোগানের ফুলকি ছড়াই।
বারবার আমাদের হাত হয় উদ্দাম নিশান,
বারবার ঝড়ক্ষুব্ধ পদ্মা হই আমরা সবাই।


আমাকেই হত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
উনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে
এভন্যুর মোড়ে
মিছিলে, সভায়-
আমাকেই হত্যা করে, ওরা হত্যা করে বারবার।
তবে কি আমার


বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হ’য়ে যাবে ?





Wednesday, May 10, 2017

সাম্যবাদী-কাজী নজরুল ইসলাম

সাম্যবাদী -কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ওকেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

Monday, May 8, 2017

স্বাধীনতা-তুমি

স্বাধীনতা তুমি

শামসুর রহমান




স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,


                                                  যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।



Thursday, May 4, 2017

বনলতা সেন

বনলতা সেন
 জীবনানন্দ দাশ


হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।



Monday, May 1, 2017

আমাদের ছোট নদী

আমাদের ছোট নদী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি। 


চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক। 


আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাহিবার কালে
গামছায় জল ভরে গায়ে তারা ঢালে। 


সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে। 


আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।

দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।